অভাবে ত্যাগ

স্বরূপা রায়,শিলিগুড়ি বার্তা ওয়েবডেস্ক,৫ই আগস্ট:ইটভাটার কাজ শেষ করে হাতমুখ দিয়ে বাকি মজদুরদের সাথে রাজুও মজুরী নেওয়ার লাইনে দাঁড়ালো। মালিক একজন একজন করে সবাইকে তাদের পাওনার সাথে দুইশো টাকা করে বেশি দিচ্ছে, দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে।
রাজুও পাওনার মজুরির সাথে দুইশো টাকা বেশি পেল। এবার দুর্গাপূজায় বাড়ির সবার জন্য কিছু একটু অন্তত নিয়ে যেতে পারবে, রাজু এটা ভেবেই খুশি।
রাজু ইটভাটা থেকে বেড়িয়ে বাজারে এলো। ফুটপাতের দোকানগুলোয় দেখতে দেখতে এগোতে লাগলো রাজু। একটা দোকান থেকে মেয়ের জন্য একটা ফ্রক, স্ত্রী আর মায়ের জন্য শাড়ি আর বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনলো।
রাজুর স্নায়ুরোগ আছে। ঠিকমতো ঔষধ না খেলে, মাঝে মাঝে অসহ্য মাথার ব্যথা হয়। অনেকসময় তো অজ্ঞানও হয়ে গেছে।
সবার জন্য সবকিছু কেনার পর রাজু যখন পকেটের টাকাটা গুনতে গেল, তখন দেখলো যে যা টাকা আছে তা সংসারে লাগবেই। এইদিকে রাজুর ঔষধও শেষ। সংসারের কথা ভেবে রাজু ঔষধ না কিনেই বাড়ি ফিরলো।
বাড়ি ফিরতেই রাজুর ছয় বছরের মেয়ে দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। রাজু মেয়েকে আদর করে বললো, "তোর জন্য পূজার জামা এনেছি মা।"
"কোথায় বাবা? মা বলেছিল তুমি নিয়ে আসবে।" রাজুর মেয়ে বললো।
রাজু মেয়ের জামাটা বের করে ওর হাতে দিল। মেয়ে জামাটা দেখে জিজ্ঞেস করলো, "একটাই জামা এনেছো বাবা? আমার বন্ধুদের তিনটে করে জামা হয়েছে, তিনদিন তিনটে পড়বে।"
"এবার একটা দিয়েই কাজ চালিয়ে দে মা। পরের বছর তিনটে কিনে দেবো।" রাজু বললো।
"ধুর" বলে রাজুর মেয়ে জামাটা ফেলে দিয়েই ঘরের ভেতরে চলে গেল।
রাজুর গলা শুনে রাজুর মা, স্ত্রী আর বাবাও বেড়িয়ে এলো।
"কি হলো? তোমার মেয়ে তোমার উপর রেগে গেল মনে হচ্ছে।" রাজুর স্ত্রী বললো।
"হ্যাঁ, ওর সব বন্ধুদের তিনটে করে জামা হয়েছে। আর আমি ওর জন্য একটা এনেছি, তাই জন্য।" রাজু বললো।
"রেগে যাওয়ারই কথা! সারা বছর কাজ করে যদি মেয়ের মুখে হাসিই না ফোটাতে পারো, তবে এমন কাজ করে লাভ নেই।" রাজুর স্ত্রী বললো।
রাজু কিছু না বলে শুধু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। তারপর হাতের প্লাস্টিক ব্যাগটা থেকে সবার জন্য আনা জিনিস বের করে যার যারটা তার তার হাতে দিয়ে বললো, "তোমাদের জন্য এইটুকু নিয়ে এলাম। দেখে বলো, কেমন লাগলো।"
স্ত্রী নিজের শাড়ি দেখেই রাজুর মায়ের শাড়িটায় উঁকি মারলো। আর রাজুর মা আবার উলটো, রাজুর স্ত্রীয়ের শাড়িতে উঁকি দিল। রাজুর স্ত্রী ভাবছে, শাশুড়ির শাড়িটা দামী৷ আর রাজুর মা ভাবছে, ছেলের বউয়ের শাড়িটা দামী।
অবশেষে দুজনেই অসন্তুষ্ট হয়ে বললো, "ঠিকই আছে।"
"পছন্দ হয়েছে?" রাজু জিজ্ঞেস করলো।
"রংটা বেশি হাল্কা! যাই হোক, চালিয়ে নেবো। আমার অতসত নেই, না হলেও চলতো।" রাজুর মা বললো।
"অন্য ডিজাইন হলে ভালো হতো। এই ডিজাইনটা পুরোনো। নিলুর মা গত বছর এমন পড়েছিল।" রাজুর স্ত্রী বললো।
"আমার যা কামাই তা দিয়ে এই পেলাম। চেষ্টা করবো পরের বার আরেকটু ভালো আনার।" রাজু বললো।
রাজুর কথা না শুনেই রাজুর মা আর স্ত্রী ঘরের ভেতরে চলে গেল। রাজু এবার বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে, ওর বাবা ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
"কি হলো বাবা? তোমারও পছন্দ হয়নি না?" রাজু জিজ্ঞেস করলো।
"কে বলেছে? খুব সুন্দর হয়েছে। কি দরকার ছিল আনার? এই বুড়ো বয়সে নতুন জামা লাগেনা।" রাজুর বাবা বললো।
"না বাবা, এতটুকুই তো পারি। আমারও তো মন চায়, তোমাদের জন্য কিছু করতে।"
"নিজের জন্য কি কিনেছিস?"
"আমার আবার কি লাগবে? আমি তো কাজকর্মেই বেশি থাকি। ভালো জামাকাপড়গুলো তো পড়েই থাকে। ওগুলো না পড়তে পড়তে নষ্ট হয়ে যাবে। ওগুলোই পড়বো বাবা।"
রাজুর বাবা কিছু না বলে ছেলের ঘাড়ে হাত রাখলো।
"আচ্ছা বাবা, আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।" রাজু বলে এগিয়ে যেতে নিলে ওর বাবা পেছন থেকে বললো, "তোর ঔষধগুলো কিনে টেবিলে রেখেছি।"
"বাবা?" রাজু অবাক হয়ে বললো।
"তুই কি ভাবলি আমি কিছু বুঝিনা? সবার জন্য জামাকাপড় কিনতে গিয়ে যে তোর ঔষধটাই কেনা হবেনা, তা আমি জানতাম। তাই আগেভাগেই টুকটাক কাজ করে টাকা জমিয়ে কিনে রেখেছিলাম এক মাসের ঔষধ।" রাজুর বাবা বললো।
"বাবা..." বলে রাজু জড়িয়ে ধরলো রাজুকে।
"আমিও যে তোর মতোই পুরুষ বাবা। আমি জানি, আমাদের মতো গরীব পুরুষদের কত ত্যাগ করতে হয়।"
Leave a Comment